যুগশ্রেষ্ঠ মুফতি শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি

যুগশ্রেষ্ঠ মুফতি শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি
মাওলানা মুফতি কাজী মুহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ
———————————————
কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর সমষ্ঠি উসূলে আরবা‘আ গবেষণা করে ফিকহি মাসআলা সমাধান দেয়া একজন ফক্বীহর প্রধান দায়িত্ব। মুসলিম বিশ্বে যুগে যুগে বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে ও হবে, সেগুলোর সমাধান দেয়া মূলতঃ অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। ফক্বীহ, কুরআন-সুন্নাহ্, ইজমা-কিয়াসের আলোকে যে সমাধান দিয়েছেন ও ভবিষ্যতে দেবেন তা জনসম্মুখে লিখিত বা মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয়া মুফতির পরম ও পবিত্র দায়িত্ব। হযরত ইমাম আ’যম আবূ হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও তাঁর বিখ্যাত ছাত্র ইমাম মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম যুফার রহমাতুল্লাহি আলায়হিম পৃথিবীর অধিকাংশ মাসআলা-মাসায়িলের সুন্দর সমাধান উপস্থাপন করেছেন, সে সমাধানগুলো হযরত ইমাম মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছয়টি বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। পরবর্তী যুগের ফোকাহায়ে কেরাম এ কিতাবগুলোর উপর ভিত্তি করে ফিক্বহ্ ফতওয়ার আরো গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করে হানাফী মাযহাবকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করেছেন।

প্রত্যেক যুগে যুগে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদের যুগ জিজ্ঞাসার সমাধান দেওয়ার জন্য মুফতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ শেরে মিল্লাত শায়খুল হাদীস ওবাইদুল হক নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুফতি ছিলেন। তিনি ১৯৬২ ও ১৯৬৪ খৃ. সালে দু’ দফা পশ্চিম পাকিস্তানের জামেয়া ন‘ঈমীয়ার তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুফতী ও মুহাদ্দিস হযরতুল আল্লামা আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সান্নিধ্যে থেকে এ বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন। তাছাড়াও ১৯৬৬ খৃ. সালে ঢাকা আলিয়া হতে ফিকহ বিষয়ে উচ্চতর সনদ অর্জন করেন। ফতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি আবেদনকারী থেকে প্রশ্নটি লিখিতভাবে নিতেন যাতে করে প্রশ্নকর্তা নিজ অবস্থান থেকে সরে যেতে না পারেন। এটা তাঁর তীক্ষ্ম বুদ্ধির পরিচয় বহন করে। তারপর তিনি হানাফী মাযহাবের অভিমত অনুসারে ফতওয়া দিতেন। ফতওয়া দেয়ার বেলায় তিনি হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাবের উদ্ধৃতিসহ রেফারেন্স দিতেন। বিশেষ করে কুদুরী, শরহে বেকায়া, হেদায়া, ফাতওয়ায়ে আলমগীরি, ফাতওয়ায়ে শামী, ফতওয়ায়ে কাযী খাঁন, ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, বাহারে শরীয়ত, ফতওয়ায়ে রজভীয়াসহ আরো বহু গ্রন্থের হাওলা সহকারে ফতওয়া দিতেন। কেউ কোন দিন তাঁর প্রদত্ত ফতওয়া রদ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। মূলতঃ তাঁর তাকওয়া-পরহেযগারী, প্রখর স্মৃতি শক্তি, আপন মুরশিদের প্রতি পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধা, আওলাদে রসূলের প্রতি আন্তরিক মুহাব্বত, দরস-তাদরীসে একনিষ্ঠতা, দ্বীন ও মিল্লাতের প্রতি আন্তরিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, বাতিলের প্রতি আপোষহীনতা, প্রিয় নবীর প্রতি প্রচন্ড ইশক ও মুহাব্বত, দায়িত্বশীলতা, কর্মদক্ষতা, বাকপটুতা, তেজস্বীতা, সর্বোপরি মিষ্ট ব্যবহার তাঁকে অতুলনীয় করেছে। তাঁর চমৎকার তকরীরগুলো আমাদেরকে বিমোহিত করত। তার পাঠদান আমাদেরকে চমৎকৃত করত। পান্ডিত্যপূর্ণ কথাগুলো আমাদের হৃদয়ের গভীরে রেখাপাত করত। কোন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলে কুরআন-হাদীস ও ফিক্বহের কিতাব থেকে একের পর এক দলীল উপস্থাপন, সারগর্ভ আলোচনা, যুক্তিনির্ভর ও বাস্তবধর্মী বক্তব্য শ্রোতার মন জয় করে নিত।
বাতিলের সাথে কোন মুনাযিরায় তিনি পরাজিত হননি। ইমাম শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে রপ্ত করা টেকনিক দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করতেন, ইমাম হাশেমী রহমাতুল্লাহি আলায়হির ইলমের ওয়ারিস ছিলেন আল্লামা নঈমী, মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী থেকে পাওয়া মিরাসগুলো চমৎকারভাবে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি শুধু একজন দক্ষ মুফতী ছিলেন তা নয়, তিনি সমানভাবে একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসির ও শায়খুল হাদীস ছিলেন। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা মাপা সহজসাধ্য নয়। তাঁর তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও দুরদর্শী চিন্তা-চেতনা আমাদেরকে হতবাক করে দেয়। নির্লোভ, নিরহংকারী একজন আলেমেদ্বীন হিসেবে তিনি আমাদের অনুসরণীয়। জামেয়া, আনজুমান, সিলসিলা, গাউসিয়া কমিটি, সুন্নীয়ত, মসলকে আ’লা হযরতের জন্য সারাটি জীবন উৎসর্গ করে গেছেন তিনি। সর্বোপরি আধ্যাত্মিক সাধনায় তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন।
তাঁর ইন্তেকালের পর আওলাদে রসূল শায়কে ফা’আল সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) যে মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। ‘‘মুফতী সাহাব পর মাশায়িখ হযরাত হোশ হ্যাঁয়।’’ ফানা ফীশ শায়খ হিসেবে তাঁর বড় প্রাপ্তি এটা। আমি নিজেকে ধন্য মনে করি প্রথমত আমি হুযুরের একজন নগন্য ছাত্র, সর্বোপরি কর্মক্ষেত্রে তাঁর সহকর্মী। আমি তাঁর ছাত্র হলেও তিনি আমাকে মাওলানা আবদুল ওয়াজেদ বলে সম্বোধন করতেন, আমাকে খুব বেশি ¯েœহ করতেন। তাঁর সঙ্গ ও সুহবত আমাদেরকে আলোকিত করেছে। আমি মনে করি তিনি একজন সফল আলেমেদ্বীন। আশেকে রসূল, বিখ্যাত মুফতী, জগত সেরা শায়খুল হাদীস ও ওয়ায়য। যাঁর সুললিত কণ্ঠের ওয়াযগুলো মানুষের মনে রেখাপাত করত। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হত ইশকিয়ানা শে’র, সুমধুর কণ্ঠের সে না’তগুলো আমাদের বিমোহিত করত অনায়াসে।

সুন্নীয়ত প্রচার-প্রসারে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর প্রথম ওফাতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে কামনা করি আল্লাহ্ যেন তাঁকে জান্নাতের আ’লা মকাম নসীব করেন। আমিন, বিহুরমতি সাইয়্যিদিল মুরসালিন।

লেখক: প্রধান ফকীহ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম,
প্রেসিডিয়াম সদস্য, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত, বাংলাদেশ।

Leave a Reply