ইতিহাস

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একাত্তরের পরাজিত ঘাতকচক্র তাদের ধার্মিকতার মুখোশের আড়ালে নবীদ্রোহী তৎপরতার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে অগ্রসর হয়। এ লক্ষ্যে সেই নবীদ্রোহী চক্র দেশের আনাচে-কানাচে নানা উপায়ে সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদের মাঝে তাফসিরের নামে পবিত্র কোরআন-এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে প্রিয় হাবীবে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে অবমাননা শুরু করে। তখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত-এর শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও পীর মাশায়েখ সংঘবদ্ধ ছিলেন না। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামের ছোবহানিয়া আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী এম.এ মতিনসহ কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টায়, এবং মোহাদ্দিস আল্লামা শাহ আলাউদ্দিন (রহ.)-এর অনুপ্রেরণায় ‘জমিয়তে তোলাবায়ে আহলে সুন্নাত’ নামে একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উদ্যোক্তা এম.এ.মতিন-এর প্রস্তাবে, এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুবিধার্থে তাঁর সহপাঠি মুহাম্মদ ইব্রাহিম নামক এক ছাত্রকে আহবায়ক, এবং এম.এ. মতিনকে যুগ্ম-আহবায়ক করা হয়।

১৯৭৮ সালের ১লা মহররম মোহাদ্দিস আল্লামা শাহ আলাউদ্দিন (রহ.) ছোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদের সভাপতি চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রথিতযশা শিল্পপতি আলহাজ্ব ইসলাম মিয়া টি.কে সাহেবকে উন্মুক্ত মঞ্চে ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবহিত করেন। উক্ত সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে তাঁর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইসলাম মিয়া টি.কে সাহেব বিষয়টি জেনে আনন্দিত হন, এবং সংগঠনের কার্যক্রম বেগবান করতে অবারিত হস্তে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। এ ব্যাপারে মাদরাসার অধ্যক্ষ পীরে তরিকত হজরত আল্লামা সৈয়দ শামসুল হুদা (রহ.)ও ঐকমত্য প্রকাশ করেন, এবং পরবর্তীতে অধ্যক্ষ সৈয়দ শামসুল হুদা (রহ.) সুন্নীয়তের সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত সুদৃঢ় করতে অনন্য ভূমিকা ও অবদান রাখেন। সেসময় মাদরাসার আবাসিক হলের নিচতলায় ওই সংগঠনের উদ্যোক্তা এম.এ.মতিনের ৯নং কক্ষটি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে রূপ নেয়। অতঃপর এ কক্ষে ধীরে-ধীরে সুন্নি ছাত্ররা বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা সংগঠনটি এই মাদরাসার গণ্ডিবদ্ধ না রেখে চট্টগ্রামের অন্যান্য সুন্নী মাদরাসায়ও সাংগঠনিক কাঠামো প্রসারিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এম.এ.মতিন ও স.উ.ম. আবদুস সামাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাদরাসার অধ্যক্ষ আল্লামা সৈয়দ শামসুল হুদা (রহ.) ও মোহাদ্দিস আল্লামা শাহ আলাউদ্দিন (রহ.)’র সহায়তায় ও পরামর্শে সিনিয়র ওলামা-মাশায়েখের নিকট জাতীয় পর্যায়ে ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন মাদ্রাসায় দাওয়াত নিয়ে গেলে অনেকেই ঐকমত্য পোষণ করলেও কেউ-কেউ সংগঠন করায় দ্বিমত পোষণ করেন। এম.এ.মতিন, স.উ.ম. আবদুস সামাদ ও মুহাম্মদ ইব্রাহিম প্রমুখের প্রচেষ্টায়, এবং মোহাদ্দিস আল্লামা শাহ আলাউদ্দিন (রহ.)-এর সহায়তায় শুরুতে শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম দফায়-দফায় বৈঠক করেন।

জাতীয় পর্যায়ে ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড ময়দানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দেবপাহাড় এলাকায় অবস্থিত আহলা দরবার শরীফের তৎকালীন সাজ্জাদানশীন পীরে তরিকত হজরত আল্লামা সৈয়দ সেহাব উদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশতি (রহ.)-এর খানকায়ে নূরীয়াতে সম্মিলিতভাবে সর্বশেষ ৪র্থ বৈঠকে মিলিত হন- ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.), পীরে তরিকত হজরত আল্লামা সৈয়দ সেহাব উদ্দীন খালেদ আল কাদেরী আল-চিশতি (রহ.), আল্লামা অধ্যক্ষ জাফর আহমদ ছিদ্দিকী (রহ.), শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী (রহ.) প্রমুখ প্রথিতযশা সুন্নি ওলামায়ে কেরাম। সেই বৈঠকে নামকরণের প্রসঙ্গে তাঁদের দু-একজন পূর্বের নাম বহাল রাখতে মতপ্রকাশ করলেও অধিকাংশ মত দেন যে, যেহেতু এই সংগঠনটি শুধু মাদ্রাসার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে, সেহেতু বাংলায় নাম রাখা উচিত। তখন মরহুম মুহাম্মদ আকতার হোসেন নান্টু ‘ছাত্রসেনা’ নামটি প্রস্তাব করে এর স্বপক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। আর উপস্থিত সবাই তাঁর প্রস্তাবকে সমর্থন করেন, এবং ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা নামের সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তারপর কমিটি গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে বিভিন্নজন বিভিন্ন জনের নাম প্রস্তাব করেন। অতঃপর উক্ত বৈঠকে বিভিন্নদিক আলোচনা ও পরামর্শের পর এই মর্মে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেন যে, এমন একজন ছাত্রকে প্রধান করা প্রয়োজন, যিনি মাদ্রাসা ও কলেজ উভয় দিক থেকে শিক্ষিত ও মেধাবী হিসেবে সর্বজন গ্রহণীয় হবেন। এই বিবেচনায় এম.এ মতিন ও স.উ.ম আবদুস সামাদ এশিয়াখ্যাত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া ও চট্টগ্রাম সরকারি মহসিন কলেজের তৎকালীন মেধাবী ছাত্র, এবং ঐতিহ্যবাহী ছোবহানীয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার তৎকালীন শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান-এর নাম প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে প্রস্তাব করেন। শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.) প্রস্তাবটি সমর্থন করেন, এবং উপস্থিত ওলামা-মাশায়েখও ঐকমত্য প্রকাশ করেন। সুতরাং, ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি মাওলানা এম.এ.মান্নানকে আহবায়ক, মুহাম্মদ আলী হাসিনকে যুগ্ম-আহবায়ক, এম.এ.মতিন, মুহাম্মদ আকতার হোসেন নান্টু, সৈয়দ মুহাম্মদ অছিউর রহমান, সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, নিজাম উদ্দিন মাহমুদ, স.উ.ম.আবদুস সামাদ, হাফেজ মুহাম্মদ আব্দুল হাই, মুহাম্মদ আব্দুল মোতালেব ও মুহাম্মদ নাজমুল হাসানকে সদস্য করে ১১ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নিয়ে ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা’ নামে জাতীয়ভাবে সুন্নীয়তের সর্বপ্রথম সাংগঠনিক যাত্রার সূচনা করা হয়। পরবর্তীতে প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময় মাওলানা এম.এ মান্নান সভাপতি ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

Leave a Reply