জাতি হারালো একজন নিষ্ঠাবান প্রকৃত জ্ঞানীকে!

জাতি হারালো একজন নিষ্ঠাবান প্রকৃত জ্ঞানীকে!

১.সাল ১৯৭১। চারিদিকে লম্বা আলখেল্লা পড়ে মাথায় টুপি সেঁটে কিছু নামধারী মোল্লা যখন নেমে পড়েছিল পাকিস্তানের জুলুমী শাসনকে ইসলামি শাসন হিসেবে আখ্যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বানচালের অপচেষ্টায়, ঠিক তখনই তিনি সচেষ্ ছিলেন জালিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস প্রদানে। চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি কোরআন-হাদিসের আলোকে জালিমদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য সাহস যোগাইতেন।

২.ধর্মীয় নেতারা তাদের জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের নামে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলতে দেখেছি আমরা। এসব নেতাগণ স্বীয় কর্মীবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার দৃষ্টান্ত আমরা অতীতে বহুবার দেখেছি। কিন্তু ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও বিশাল জনশক্তির ইমাম/প্রধান হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনই অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের মত ইসলামের মোড়কে রাষ্ট্র ও জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেননি নিজের, কিংবা গোষ্ঠীর ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে। ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড রুখে দিতে তিনি কখনই সহিংসতা ও উগ্রতার পথ অবলম্বন করেননি। তিনি শান্তিপ্রিয় অহিংস মতাদর্শের প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর মতাদর্শীদের আন্দোলন ছিল নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলিত। অথচ অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর উগ্রতা ও সহিংসতার চিত্র দেখে এদেশীয় জনগণ আঁতকে উঠেছিল।

৩.ইসলাম ধর্মে মতাদর্শের কারণে নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে আছে মুসলিমরা। এক মতাদর্শের মানুষ অন্য মতাদর্শের মানুষদের সহ্যই করতে পারে না একেবারে। কিন্তু উনি ছিলেন সর্বমহল, প্রায় সকল মতাদর্শী লোকেদের কাছে সম্মানের পাত্র। উনার জ্ঞান ও তাক্বওয়ার কারণেই মূলত সর্বমহলে তিনি সমাদৃত।

যাঁর কথা বলছিলাম এতক্ষণ, তিনি আর কেউ নন; চট্টগ্রামের রত্ন ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.)। যিনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এ দেশের সত্যপন্থী আলেমদের অন্যতম একজন। অসংখ্য গুণী ছাত্র ও বহু বইয়ের লেখক। গতবছর ২রা জুন তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মহান কর্মের কারণে তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের কাছে।

বেলাদত:
হুজুরের শুভাগমন হয় ১৯২৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম জেলার বায়েজিদ থানার অন্তর্গত জালালাবাদ কুলগাঁও গ্রামে। পিতা ছিলেন প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন হজরত মাওলানা আহছানুজ্জামান হাশেমি (রহ.)।

শিক্ষা জীবন:
মাত্র ৬ বছর বয়সে পবিত্র কোরআন মাজিদ হিফজ করেন। প্রাইমারি স্কুল পাশ করে ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন, এবং ১৯৪৫ সালে জামাতে পঞ্জুমের পরীক্ষায় গোল্ডমেডেল লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে জমাতে উলা পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শেষ করেন। ১৯৫১ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় টাইটেল ক্লাসে হাদিসে ভর্তি হন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দুতে ডিপ্লোমা কোর্সও সম্পন্ন করেন। হাদিস, ফিকাহ, তাফসির শাস্ত্রে অবদানের জন্য ১৯৫২ সালে হজরত আল্লামা মুফতি আমীমুল এহসান মুজাদ্দেদী বরকতী (রহ.) তাঁকে ‘নাইমুল মুরাম বে-আসানিদে আশ্ শায়ক নুরুল ইসলাম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

গ্রন্থসমূহ:

  • নসীহাতুত্ তালেবীন,
  • যাদুল মুসলেমীন,
  • আকাইদে বাতেলা,
  • সত্যের আহ্বান,
  • আদ্দুররুদ-দলায়েল বে- কেরাহতিল জামাতে ফিন্ নাওয়াফেল,
  • আল আরবাইন ফি মুহিম্মাতিদ্ দ্বীনে,
  • মেরাজুল মু’মিনিন,
  • শাজরাতুয যাহাব,
  • তাযকেরাতুল কেরামসহ বহু গ্রন্থাদি।

শিক্ষকগণ:
তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত কয়েকজনের নাম:

  • আল্লামা মুফতি আমীমুল এহসান মুজাদ্দেদী বরকতী (রহ.)। তাঁর কাছ থেকে এলমে হাদিস ও বুখারি ২য় খণ্ড অধ্যয়ন করেন।
  • আল্লামা জাফর আহমদ উছমানী (রহ.), এবং আল্লামা নজীরুদ্দীন কটকী (রহ.)। বুখারি শরিফের বাকি অংশ তাঁদের কাছ থেকে অধ্যয়ন করেন।
  • আল্লামা মুছা মুজাদ্দেদী (রহ.)। মুসলিম শরিফ, তিরমিজি শরিফ, এবং নাসায়ি শরিফ অধ্যয়ন করেন।

শিক্ষকতা:
শিক্ষা জীবন শেষে চট্টগ্রাম ওয়াজেদীয়া আলিয়া মাদরাসায় প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, এবং পটিয়া শাহচান্দ আউলিয়া মাদরাসায়ও দীর্ঘদিন শিক্ষকতায় জড়িত ছিলেন। পরে ১৯৬৪ সালে নিজ বাড়ির পাশে আহসানুল উলুম আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান:
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করার জন্যে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে নসিহতমূলক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
প্রতি রবিউল আউয়াল মাসে ১২দিনব্যাপী ঐতিহাসিক ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:) শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করতেন নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার পাশে। (Khrc)

ইন্তেকাল :
৯ শাওয়াল, ২রা জুন ২০২০ খ্রিস্টাব্দ ভোর পাঁচটায় এ মহান মনীষী পাড়ি জমান মওলার সাক্ষাতে। হুজুরের প্রথম ওফাত বার্ষিকীতে দেশ ও জাতির কাছে মুক্তিযুদ্ধের এ মহান পুরুষের রফয়ে দারাজাতের দু’আ কামনা করছি। সে সাথে মওলার কাছে ফরিয়াদ করছি, হুজুরের নেগাহ করম ও ফুয়ুজাত নিয়ে সারা বাংলায় ইসলামের সঠিক মতাদর্শ প্রচারে যেন আমরা একাগ্রচিত্তে কাজ করতে পারি সে তাওফিক দিয়ে দিন।

লেখক-
মুহাম্মদ রাশেদুল বারী,
দপ্তর সম্পাদক,
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা।

Leave a Reply